
দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ রেলওয়ে আবারও তীব্র বিতর্কের মুখে। সেবামূলক এই গুরুত্বপূর্ণ খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে নেওয়া নানা লোকদেখানো পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে বারবার। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দপ্তরে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেও রেলওয়ের প্রকৃত চিত্র এখনো অন্ধকারেই রয়ে গেছে।
সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো একটি অভিযোগপত্র সচিবালয়ের করিডোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চিঠিতে পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী তাবাসসুম বিনতে ইসলাম, যুগ্ম মহাপরিচালক মো. সাদরুল হক এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ এম মো. সালাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী তাবাসসুম বিনতে ইসলামকে চিঠিতে ‘দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতালিপ্সু সম্রাজ্ঞী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও এক প্রভাবশালী সাবেক ডিজির ছায়ায় তিনি সিনিয়র কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করে পদে পদে পদোন্নতি পান। বদলি ও পদায়নের নেপথ্য নিয়ন্ত্রণে ছিল তার সরাসরি হাত।

তাবাসসুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি সরকারি সফরের আড়ালে ১৫ বছরে ৩৫ বার বিদেশ সফর করেছেন এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি তুলে সেই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন। গাড়ি হিসেবে পাজেরো ও প্রাডোর প্রতি তার অনুরাগ এবং বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রসঙ্গও এসেছে অভিযোগপত্রে। তার স্বামী জসিম হায়দারও একসময় নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতা ছিলেন।
যুগ্ম মহাপরিচালক (মেকানিক) মো. সাদরুল হক ২০০৩ সালে রেলওয়েতে যোগ দিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর রেলভবনে থেকে গেছেন। একবার চট্টগ্রামে বদলি হলেও দুর্নীতির অভিযোগে মাত্র ছয় মাসেই ফিরিয়ে আনা হয় তাকে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি রেলওয়ের কুখ্যাত নিয়োগ বিধির প্রণেতা, যা অধিকাংশ কর্মচারীর জন্য অভিশাপ হলেও নিজের জন্য সৃষ্টি করেছেন বিশেষ গ্রেড এবং সেই পদে নিজেই পদায়িত হয়েছেন।
চিঠিতে বলা হয়, সাদরুল হক সচিব হুমায়ুন কবিরের আস্থাভাজন এবং তিনি বেয়াদব, অদক্ষ ও স্বার্থপর হিসেবে পরিচিত।
অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ এম মো. সালাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। তিনি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাগিনা এবং ছাত্রজীবনে আওয়ামী লীগ নেতা আজম নাছির উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
তাকে ঘিরে অভিযোগ রয়েছে, তিনি রেলওয়ের শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন, এবং ‘সহজ ডটকম’ অনবোর্ড সার্ভিসসহ বেসরকারি ট্রেনের লিজ আউট ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণও নিজ হাতে রেখেছেন।
এই সব অভিযোগ রেলওয়ের অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, এই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বা পুনরায় সংস্থাপন বিভাগের দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শ্রমিক অসন্তোষ চরমে পৌঁছাতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকার যদি রেলওয়েকে সত্যিকারের জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করতে চায়, তবে কেবল লোকদেখানো পদক্ষেপ নয়—প্রকৃত তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। না হলে রেলপথ মন্ত্রণালয় দুর্নীতির বিষচক্রে আটকে থেকেই যাবে।